আমাদের রাহুল মামা – ২

খাবার টেবিলে মামা কেমন যেন ভরাট গলায় আপুকে জিজ্ঞাস করল-

          % কিরে ইমি, তোর পড়াশোনার কি খবর ?

মামার কথা শুনে তো আপুর অবস্থা খারাপ। মামা সাধারনত এভাবে কথা বলে না । মনে হয় মামা আপুকে পড়াবে তাই এমন করে কথা বলছে। আপু তো ভয়ে কথাই বলতে পারছে না ।

          * এইতো মামা, চলছে –

          % চলছে মানে কি?

এবার ধমক দিয়ে মামা নিজেই হেসে দিয়েছে। আর মামার সাথে সাথে আম্মু এবং আমিও হাসছি। মামা ইচ্ছা করে আপুকে ভয় দেখিয়েছে। আর এটা বুঝতে পেরে আপুও লজ্জা পেয়েছে ।

* মামা, তুমি পঁচা। ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল এখন তুমি আমাকে টেবিলের উপর দাঁড় করিয়ে রাখবে। 

% রাখব না এখন বল কি অবস্থা ?

* অবস্থা ভালো না। প্রোগ্রামিং একদম বুঝি না, বই দেখলেই ভয় লাগে। সব মাথার উপর দিয়ে যায়। সামনে আমার পরীক্ষা এখন তুমিই পার আমাকে বাঁচাতে ।

% কি কি আছে তোদের ?

* আমাদের আছে –
Key words, identifiers, Variable, Data Type, Statement, conditional statement, Function, Loop, Array, আর String।

% কিছুই তো বাদ নাই। শোন আমি কিন্তু তোকে পড়াতে পারব না, তোকে নিজে নিজে পড়তে হবে। কিছু না বুঝলে জিজ্ঞেস করবি। আর যেহেতু গ্রীষ্মকালীন ছুটি তাই এত পড়ালেখার ও দরকার নেই। আমার কিছু পরিকল্পনা আছে, আর তাতে আমার সহকারী হিসাবে কাজ করবে ইমু। 

প্রথমদিন আমরা বাজার থেকে কিছু গ্রীষ্মকালীন ফল কিনতে যাব। যেমন আম, কাঁঠাল, লিচু। তোদের যেহেতু ছুটি মাত্র শুরু হল, তোরা শুক্রবার পর্যন্ত বিশ্রাম নে। আমরা শনিবার থেকে  শুরু করি ?

# তাহলে আমি নাই। শনিবার থেকে শুরু করলে তোমার সহকারীর চাকরিটা আমার করা হবে না।

% হা হা হা, তোর শনি ভীতি এখনও যায় নি ?

#  না যায় নি বরং দিন দিন বাড়ছে।

% হা হা, কিন্তু রবি থেকে শুরু করলে দেরী হয়ে যাবে।

*  মামা, কোন দরকার নেই আমরা কাল থেকেই শুরু করব।

% তাহলে কাল মানে বৃহস্পতিবার থেকে আমরা শুরু করব। তবে চিন্তার কোন কারণ নেই। আমরা সারাদিন অনেক মজা করব আর রাতে একটু পড়াশুনা ।

# তাহলে তো অনেক মজা হবে, আমি রাজি। বল কি করতে হবে।

% এখন আগে খেয়ে নে। এরপর খেলা দেখতে দেখতে বাকিটা বলব। 

আমরা ৯ টা ৩০ এর মধ্যে খেয়ে খেলা দেখতে বসে পড়লাম। খুব ভালো শুরু করেছে বাংলাদেশ। প্রথম ৫ বলে ৯ রান কিন্তু ওভারের শেষ বলে শূন্য রানে আউট হয়ে গেল রাশেদ। এরপর খেলা কেমন যেন ঝিমিয়ে গেছে।

% ইমু আর ইমি শোন, আমরা কি কি করব তা ঠিক করে ফেলি। তোরা স্কেচবুক টা চালু করে আমার সাথে যোগ দে।  

স্কেচবুক অনেক পছন্দের সফটওয়্যার। আগে সবাই কাগজে লিখে বুঝাত, যদি ৪/৫ জন হত তখন এভাবে বুঝাতে অনেক সমস্যা হত, সবাই তো আর কাছাকাছি বসতে পারবে না। আর এখন ২০ জন হলেও কোন সমস্যা নেই। সবার মোবাইলের স্কেচবুক অন করে কানেক্ট হয়ে নিলে, আরেকজন কিছু লিখলে বাকি সবাই টা দেখতে পারবে।

# আমি রেডি।

* আমিও রেডি।

# কিছু করতে হবে ??

% না , শুধু কি কি করব আমরা তা ঠিক করব এখন। কোন পড়ালেখা না।

* আমার কি হবে ?

% ছুটির সময় বেশি পড়াশোনা করা ঠিক না। আর পড়াশোনা করতে হলে তো তাকে আর ছুটি বলা যাবে না। তবে আমরা প্রোগ্রামিং নিয়ে আলোচনা করব প্রতিদিন রাতে। আর সারাদিন ঘুরাঘুরি। 

* পড়ালেখা না হলেই তো ভালো। কিন্তু আবার ফেল করাটাও ভালো না। তুমি যেটা ভালো মনে কর।

% হুম যা বলছিলাম,
     বৃহস্পতিবার আমরা ফল কিনতে যাব।
     শুক্রবার আমরা ঢাকার মধ্যে কোথাও ঘুরতে যাব।
শনিবার একদম কোন কাজ করা যাবে না। হা হা হা, তবে তুহিনের বাসায় যাব।
     রবিবার আমরা রমনা পার্কে যাব।
     সোমবার ও আমরা রমনা পার্কে যাব।
যেহেতু বুধবার চলে যাব তাই মঙ্গলবার একটু পড়াশোনা। তোদের স্কুল খোলা কবে?

* আমার খোলা বুধবার থেকে। খুলেই আবার বন্ধ। তুমি আরো কয়েকদিন থাকো।

% আরে না, অনেক কাজ। তাও তোদের আম্মুর আদেশ তাই না এসে পারলাম না।

# সেটা দেখা যাবে আগে তো বুধবার আসুক।

এদিকে বাংলাদেশের অবস্থা ভালো না এখন ১০২ বলে ১২৩ রান লাগবে হাতে আছে ৭ উইকেট।  

* মামা, খেলার অবস্থা দেখে তো ভালো মনে হচ্ছে না। তুমি প্রোগ্রামিং এর কিছু টিপস দাও। বেশিদিন তো আর তোমাকে পাব না ।

% ওরে বাপরে, আমি ভাবছি কত বুঝিয়ে শুনিয়ে হয়তো তোকে পড়াতে হবে আর তুই নিজে থেকে পড়তে চাচ্ছিস?

* উপায় নেই মামা, বেঁচে থাকতে হলে খেতে হয় আর খাবার জোগাড় করার জন্য কষ্ট করতে হয়। আর আমার ক্ষেত্রে পাশ করার জন্য পড়তে হয়।

% আরে আমার দার্শনিক মামা! ঠিক আছে। তাহলে মন দিয়ে শোন,

আমি যদি বলি এক গ্লাস পানি নিয়ে আয় তুই সেটা নিয়ে আসবি। কিন্তু আমি যদি একজন চাইনিজকে এক গ্লাস পানি আনতে বলি সে হা করে দাঁড়িয়ে থাকবে। চিং চং করে কিছু একটা বলবে যেটা আমি বুঝব না । তাহলে আমার কথা তুই বুঝলেও চাইনিজ লোকটা কিন্তু বুঝে নাই। এর কারণ হল, আমি আর তুই বাংলা বুঝি। আমি কিছু বললে তুই সেটা বুঝবি এবং সে কাজটা করবি। অন্যদিকে চাইনিজ লোকের কথা বুঝতে হলে দোভাষীর সাহায্য লাগবে। 
আর এখন যদি কম্পিউটারকে একটা কাজ করতে বলি যেমন ২ এর সাথে ২ যোগ করলে কত হয়? সে কি এটা  পারবে? পারবে না কারন, সে আমার কথা বুঝে নি। কম্পিউটারের ভাষা হল, বাইনারি, ০, ১। কম্পিউটার এই ০, ১ ছাড়া কিছু বুঝে না ।

* এখন কম্পিউটারের সাথে কথা বলার জন্য কি বাইনারি ভাষা শিখতে হবে?

# মামা, এই বাইনারি ভাষা কি ??

% এটা হল কম্পিউটার যা বুঝে, যেটা দিয়ে কাজ করে এখানে ০,১ ছাড়া কিছু নাই।

# ০,১ দিয়ে সব করে ?? গেম খেলার সময়ও এই বাইনারি কাজ করে?

% হুম, কম্পিউটার বাইনারি দিয়ে কিভাবে কাজ করে সেটা তোকে আরেকদিন বুঝাব, তুই এখন খেলা দেখ।

৭২ বলে ৯০ রান লাগবে হাতে আছে ৭ উইকেট।

* মামা, এখন উপায় ?

% উপায় হল দোভাষী, আমরা যেটা বলব, সেটাকে কম্পিউটারের ভাষায় রূপান্তর করে দিবে। এই দোভাষী কে আমরা কম্পাইলার বলি ।

* হি হি , তাই নাকি? আমি মনে করতাম কম্পাইলার ভুল বের করার কাজ করে।

% তাও করে, সে যদি কোনকিছু না বুঝে তাহলে সেটা জিজ্ঞাস করে। আমাদের ইরর মেসেজ দেয়।

* তাই তো! এভাবে তো ভাবি নি।

% এখন মনে কর আমি বাংলায় বললে সেটা কম্পিউটার বুঝে, তাহলে এই কম্পাইলারের আরবি শিখতে হবে, চাইনিজ শিখতে হবে, ইংরেজি শিখতে হবে, এমন করে ৩৫০০ ভাষাই শিখতে হবে।

* এটা কি সম্ভব নাকি ?

% তাহলে উপায় কি ?? আমরা বাইনারি শিখতে পারব না, কম্পিউটার আমাদের ভাষা শিখবে না, আর তাহলে  আমরা তো কথা বলতে পারব না। কেউ কারো কথা বুঝব না। তবে একটা উপায় আছে, আমরা সবাই সহজ কিছু নিয়ম ঠিক করে নিতে পারি, সেটা ইংরেজিতে হবে আর কম্পাইলারকে সেটা শিখিয়ে দিলে তখন সে আমাদের কথা বুঝবে।

* হুম এটা, আমাদের আর কম্পিউটারের দুজনের জন্যই সহজ হবে।

% এই সহজ ভাষাটাকেই তুই এত ভয় পাচ্ছিস?

* মানে কি ?

% মানে হল, এটাই হল কম্পিউটারের প্রোগ্রামিং ভাষা।

* কি বল?? সহজ কোথায় ?

# মামা, কম্পিউটার কি ০,১ দিয়েই যোগ বিয়োগ করে ?

% কম্পিউটার কিভাবে ০,১ দিয়ে কাজ করে সেটা আমি তোকে শনিবার বোঝাব।  এখন চুপ-চাপ শোন, আর প্রশ্ন থাকলে লিখে রাখ।

# মামা, আমার মনে হয়ে হেরে যাব, ৪৫ বলে ৬০ রান লাগবে, সেলিম ও আউট হয়ে গেছে, হাতে আছে আর ৬ উইকেট।

% আরে চিন্তা করিস না, ক্রিকেট অনিশ্চয়তার খেলা, শেষ হবার আগে কিছুই বলা যায় না।  আর ইমি এখন বুঝছিস কেন আমাদের কে প্রোগ্রামিং ভাষা শিখতে হবে? 

* কেন লাগবে সেটা বুঝেছি, কিন্তু এখনও এটা আমার কাছে এভারেস্টের চূড়ায় উঠার মতই কঠিন।

% চিন্তা করিস না, হেলিকপ্টার দিয়ে নিয়ে যাব, হা হা হা।

* হা হা হা, দেখা যাক, হেলিকপ্টারের তেল আছে কতটুকু!

# মামা হেলিকপ্টার উড়ে কিভাবে ??

% লিখে রাখ, এখন আর কোন কথা হবে না। খেলা জমে গেছে…

খেলার অবস্থা এখনো কিছু বলা যায় না। ৫০-৫০, যে কেউ জিততে পারে। আরিফ মাঠে যতক্ষণ আছে ততক্ষন আমাদের আশা আছে । আরিফ ৭৮ রানে অপরাজিত আছে। শেষের দিকে বাংলাদেশ ভালো করেছে এখন। এখন ৫০ তম ওভারে আমাদের লাগবে ১১ রান। ছয় বলে এগারো রান, খুব সহজও না আবার কঠিনও না।

আরিফ খুব ক্লান্ত, পায়ের মাংসপেশী তে মনে হয় টান পড়েছে, রাশেদ এসেছে রানার হিসাবে, আমাদের নতুন ব্যাটসম্যান শাহাদাত। এক রান নিয়ে আরিফকে দিল। এখন ৫ বলে ১০ রান। বল করছে অনিল, আরিফের প্রথম বল অনেক সামনে দিয়ে গেল এবং ওয়াইড। এখন ৫ বলে ৯ রান, চার কিংবা ছয় ছাড়া কোন উপায় নেই। পরের বল, ব্যাটে বল হল, চাইলে ১ রান নেয়া যেত কিন্তু আরিফ ইশারা দিল, সে রান নিতে চায় না, শাহাদাত আবার ফেরত গেল। এছাড়া উপায়ও নেই। আরিফই আমাদের শেষ ব্যাটসম্যান। ৪ বলে ৯ রান, সবাই দোয়া পড়ছি। আম্মু তো ২ রাকাত নামাজ পড়ে আসছে, এখনও দোয়া করছে বসে বসে। অনিলের ইয়র্কার কোন মতে ঠেকালো আরিফ, আমাদের জন্য এখন খুব কঠিন। ৩ বলে ৯ রান, ভারতের সবার মুখে হাসি। পরের বল, আরিফ ২ পা বেড়ে অফ ড্রাইভ করল ৪ রান। এই ৪ রান অনিলের খুব একটা ভালো লাগে নাই। ২ বলে ৫ রান।কয়েকজন গিয়ে অনিলকে পরামর্শ দিয়ে আসলো, এখনো খেলাটা বেঁচে আছে, যে কেউ আজ জয়ী হতে পারে।

আম্মু জোরে জোরে দোয়া পড়ছে। এমনিতেই আরিফ সুস্থ না, তার উপর আবার বাউন্সের বল খেলতে গিয়ে হাতে ব্যাথা পেয়েছে। সারা মাঠে নিস্তব্ধতা, মাঠে ডাক্তার চলে আসছে, অন্য খেলোয়াড়রা ভীর করে দাঁড়িয়ে আছে। আরিফের অবস্থা খুব খারাপ, সে কাঁদছে আর ডাক্তার হাতের গ্লাভস খুলে দেখে আঙুল ফেটে গেছে, রক্ত পড়ছে। মাঠে বাংলাদেশের সব সাপোর্টাররা কাঁদছে। আমি কাঁদছি, আম্মু কাঁদছে, ইমি আপুতো জোরে জোরে কাঁদছে। নাহ, আরিফ আর আজ খেলতে পারবে না। আউট করতে না পেরে আহত করল তারা। ৮২ রানে অপরাজিত থেকে জয়ের দ্বারপ্রান্তে থেকে আহত অবস্থায় কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছাড়ছে আরিফ, মাঠের সবাই দাঁড়িয়ে সন্মান জানাচ্ছে আরিফকে। সবার চোখে পানি। অন্য দিকে জয়ের জন্য মরিয়া ভারত। এখন এক বলে ৫ রান লাগবে, মাঠে নেমেছে দিনার, খুব ভালো বল করে, ব্যাট হাতে মোটামোটি। কিন্তু এখন ছয় ছাড়া উপায় নেই , শেষ বল ৫ রান।

বাংলাদেশের ১৪ কোটি মানুষ কাঁদছে আর দোয়া করছে। স্বপ্নের ওয়ার্ল্ডকাপ আর মাত্র এক বল পরেই হাত ছাড়া হয়ে যাবে, নাকি আমাদের স্বপ্ন আজ সত্যি হবে ? অনিলের আবার বাউন্স, আগের বলের বাউন্সে আরিফ আহত হয়েছে।তাও দিনার অনেক চেষ্টা করল ব্যাট লাগাতে পারল না। মাথার উপর দিয়ে চলে গেল। সব শেষ,  তাও কিছু রান কমানোর জন্য দিনার আর শাহাদাত দৌড়াচ্ছে, পিছনের ফিল্ডারাও  দৌড়াচ্ছে। এটা চার হলেও ম্যাচ টাই হবে, সুপার ওভার খেলা হবে। এত উপর দিয়ে গেছে যে উইকেটকিপার ও ধরতে পারে নাই। মনে হচ্ছে হৃদ স্পন্দন বন্ধ হয়ে আছে। না বল চলে গেল মাঠের বাইরে, এত গতির বল আটকানো কঠিন, কিন্তু না আম্পায়ার ওয়াইডের সংকেত দিলেন উচ্চতার কারনে।

তার মানে ৫ রান !!!

এক বল হাতে রেখেই আমরা জিতে গেছি। এবার কান্না হাসিতে রূপান্তর হল। এ যেন স্বপ্ন দেখছি, বিশ্বাসই হচ্ছে না। মাঠের সব দর্শক যেমন খুশিতে চিৎকার করছে আমরাও বাসার সবাই চিৎকার করছি, লাফাচ্ছি। টিভিতে শেষের বল বার বার দেখাচ্ছে। এখন অনিলের চোখে পানি, মাঠের মাঝে বসে কাঁদছে। অনিলের এই অবস্থা দেখে – আম্মু বলছে “উচিত বিচার করছে আল্লাহ”। আম্মুর চোখে পানি, মুখে হাসি। আজ আমরা সবাই অনেক খুশি।

আমাদের প্রথম ওয়ার্ল্ডকাপ।

কিছু ভিডিও- যা এই গল্পের বিষয় বস্তু বুঝতে সাহায্য করবে –

আরো গল্প

Leave a Reply

Your email address will not be published.