অনেকদিন পর আমি, আম্মু আর ইমি আপু একসাথে বসে খেলা দেখছি। সবসময় একসাথে বসে টিভি দেখা হয় না। আগে নাকি বাসার সবাইকে একসাথে বসে টিভি দেখতে হত, বাসায় একটি টিভি থাকতো। কেউ যদি খবর দেখতো তাহলে সবাইকে খবর দেখতে হতো। আর এখন সবার কাছেই ট্যাব বা মোবাইল আছে। আর এখন মোবিস্ক্রিন [1] (মোবাইলের পোর্টেবল প্রোজেক্টর) তো আছেই । যার যা খুশি দেখতে পারে, আর সবাই ভিন্ন ভিন্ন অনুষ্ঠান দেখলেও কারো কোনো সমস্যা হয় না কারণ এখন সবাই এয়ারপ্লাগ [2] ব্যবহার করে। আজ বাংলাদেশ ও নিউজিল্যান্ডের সেমিফাইনাল খেলা হচ্ছে। প্রথমে নিউজিল্যান্ড ব্যাটিং করে ৩২১ রান করেছে৷ একটু পর বাংলাদেশ ব্যাটিং শুরু করবে। ইমি আপুর ডিসেম্বরে এইচ.এস.সি বোর্ড পরীক্ষা। তাই খুব ভয়ে আছে। খেলা দেখতে দেখতে পড়ছিল। পরের বছর আমার এস.এস.সি পরীক্ষা। আগে অনেক পরীক্ষা ছিল পি.এস.সি, জে.এস.সি, এস.এস.সি, এইচ.এস.সি। এরপর আরো আছে ইউনিভার্সিটির বি.এস.সি, এম.এস.সি, পি.এইচ.ডি। এখন ইউনিভার্সিটির আগে শুধু দুইটি পরীক্ষা৷ সামনের বছর ক্লাস এইটে আমি এস.এস.সি দিব, আর আপু এখন ক্লাস ১২ তে এইচ.এস.সি দিবে।
এখনও খেলা শুরু হয়নি। হঠাৎ আপু চিৎকার দিয়ে আমাদের কাছে ছুটে আসলো।
* আম্মু, আম্মু আমি তো বিলিনিয়র হয়ে গেছি ।
আমি আর আম্মু তো কিছুই বুঝলাম না, হা করে তাকিয়ে আছি।
~ কি হয়েছিস?
# আপু, বিলিনিয়র কি জিনিস?
* আমি লটারিতে ১০ লাখ টাকা জিতেছি !
~ বিলিনিয়র তো ১০০ কোটিতে হয়, আর ১০ লাখে মিলিনিয়র।
* ও তাহলে মিলিনিয়র হয়ে গিয়েছি!
আমি আর আম্মু তো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না কিন্তু কেমন যেন উত্তেজিত হয়ে পড়লাম।
~ কোথায় পেলে এত টাকা ?
* আম্মু আমি লটারি জিতেছি। আর্থ ফাউন্ডেশনের লটারি!
# তাই নাকি ??
* মাত্রই ই-মেইল পেলাম কালকের মধ্যে ব্যাংকের ডিটেলস দিতে বলেছে, টাকা পাঠিয়ে দিবে। শুনেই আমার কেমন কেমন লাগলো। তাও আপুকে কিছু বুঝতে দিলাম না ।
# ওয়াও, আপু তুমি কিন্তু আমাকে মাইবুক [3] কিনে দিবে।
* কেন দিব না ! সব কিনে দিব, আমার একমাত্র ভাই তুই।
# ওকে। চল তোমার ই-মেইল টা দেখি।
* চল, চল, আর আম্মু তুমিও চল। একটা ফর্ম পূ্রণ করতে হবে।
আপুর পিছন পিছন আমি আর আম্মু আপুর রুমে গেলাম। আপু তো খুশিতে কি যে করবে বুঝতে পারছে না।
* এই দেখ, ১০ লাখ। কালই পেয়ে যাব, ভাবতেই কেমন যেন লাগছে। মনে হয় আজ রাতে ঘুমাতে পারবো না ।
# হুম, কোথায় তথ্য দিতে হবে ?
* এই যে এখানে৷ ওদের এখানে একটা একাউন্ট খুলতে হবে আর সেখানে আমার ব্যাংকের ডিটেলস দিতে হবে। সব ঠিক থাকলে কাল বা পরশু টাকা পাঠিয়ে দিবে।
এদিকে আমি লিংক টা ভালো করে চেক করলাম। যা ভেবেছিলাম তাই। এটা একটা ফিশিং। আপু জালে ধরা পড়ছে।
# না দিবে না, উল্টো নিয়ে যাবে।
আমার কথা শুনে আপু আর আম্মু দুজনেই আমার দিকে তাকালো। আপু তো ক্ষেপে গেছে।
* আম্মু তোমার এই ছেলেকে বল চুপ করতে। ইচ্ছা করে আমাকে ক্ষেপাচ্ছে।
# আম্মু তোমার এই আদরের মেয়েকে বাঁচাতে হলে এখনই থামাও। কাল যখন টাকা পাবে না উল্টো সব নিয়ে যাবে তখন কিন্তু শোকে পাগল হয়ে যেতে পারে।
~ কি বলছিস?
# ঠিকই আম্মু, আপু জালে ধরা পড়েছে।
* আবার !!!
~ এই আমি দেখছি, কিসের জালে? আর তুই বুঝলি কিভাবে যে, ওরা টাকা দিবে না ?
# এই যুগে যদি এটা না বুঝি তাহলে আন্দামান চলে যাওয়া ভালো।
* চুপ কর। বেশি কথা বলিস তুই। আম্মুর প্রশ্নের জবাব দে। তুই জানলি কিভাবে?
# খুব সহজ। এই যে, এই লিংক থেকে। এটা একটা ভুয়া ওয়েবসাইট। ঠিকানার পাশে সবুজ রঙের নিরাপদ চিহ্নটি নাই। এরা এসএসএল ও ব্যবহার করে নি। শুধু তাই না ওয়ানসার্চ করেও দেখলাম অনেকেই রিপোর্ট করেছে এমন লটারির ব্যাপারে।
* তুই কি নিশ্চিত ?
# বিশ্বাস না হলে তুমিই খুঁজে দেখ।
* না তা আর দেখতে হবে না ।
# তবে মন খারাপ করো না। ফী ছাড়া তুমি সাইবার সিকিউরিটির উপর একটি কোর্স করে ফেললে। তোমার এই ঘটনাকে বলে ফিশিং। তারা স্প্যামিং করে তোমাকে মেইল পাঠিয়েছে আর আর্থ ফাউন্ডেশনের মত দেখতে একটি নকল ওয়েবসাইট তৈরি করেছে। মাছ ধরার জন্য আমরা যেমন বড়শিতে খাবার দিয়ে ফাঁদে ফেলি, তারা তাই করেছে আর আপু ধরা পড়েছে।
আপু মনে হয় এখন বিশ্বাস করতে পারছে না। আমাকে সরিয়ে আবার সার্চ করে দেখলো। এরপর মন খারাপ করে বসে আছে। আমি আম্মুকে বুঝিয়ে বললাম আবার। আমি আর আম্মু তো হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছি। আর আমাদের দেখে আপু আরো ক্ষেপে যাচ্ছে।
* অনেক হয়েছে, যাও এবার। তোমাদের বলেই ভুল হয়েছে আমার।
# আপু ভুল হয় নি। বেঁচে গিয়েছ। তা নাহলে তারা হয়ত তোমার সব টাকা নিয়ে যেত। হা হা …
* কচু নিত। কিভাবে নিবে? আমি তো আর তাদেরকে পাসওয়ার্ড দেই নি। আমি কি এত বোকা নাকি ??
# এত বোকা না তবে তাদের কাছে তুমি বোকাই।
* যা এখান থেকে।
# আমি এমনি এমনি বলি নি। তুমি এখানে যে অ্যাকাউন্ট করেছ আর ব্যাংকের তথ্য দিলে তারা এখান থেকে তথ্য নিয়ে হ্যাকিং এর চেষ্টা করত। আর এর বেশি তথ্য লাগলে হয়ত আবার তোমাকে ই-মেইল দিত। বলত আরো কিছু তথ্য দিলে আপনার টাকা দ্বিগুণ করে দিব। আর তুমি তাই দিতে।
* যা এখান থেকে, আমার পড়া আছে …
আম্মু আপুর অবস্থা দেখে-
~ আরে লটারি পাসনি তো কি হয়েছে ? তারপরও আজ পার্টি হবে। এই ইমু চিপফুডে একটা পিজ্জার অর্ডার দে, হোম ডেলিভারির জন্য।
পিজ্জার কথা শুনে আমরা যেন আগের সব ঘটনা ভুলে গেলাম। আম্মুর কথামত আমি অর্ডার দিয়ে দিলাম। ড্রোভারের [4] ডেলিভারি খুব তাড়াতাড়ি চলে আসে। এখন সবার ছাদেই ড্রোপ্যাড [5] আছে। প্রতিটি ড্রোপ্যাডের একটি ইউনিক নাম্বার আছে। আমি অর্ডার দেওয়ার সময় আমাদের ড্রোপ্যাডের নাম্বার দিয়ে দিয়েছি। চিপফুড থেকে ড্রোনে আমাদের বাসার ছাদে পিজ্জা দিয়ে যাবে৷ এতে পাঁচ থেকে ছয় মিনিট সময় লাগতে পারে। অর্ডার দিয়েই আমি আর আপু ছাদে চলে গেলাম।
ছাদে গিয়ে দেখি, ড্রোপ্যাডে পিজ্জা নিয়ে ড্রোভারের ড্রোনটি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমি গিয়ে ড্রোনটির ডিসপ্লেতে যে কোড আছে তা স্ক্যান করে টিপটপ [6] থেকে টাকা পেমেন্ট করে দিলাম। এরপর ড্রোনটি প্যাকেট রেখে আবার উড়ে গেল।
আমি আর আপু পিজ্জা নিয়ে বাসায় আসলাম। এসে দেখি আম্মু চিন্তিত।
# কি হল ? আপুর জন্য মন খারাপ নাকি ?
~ আরে না! কোটিপতি ইমির কথা তোর মামাকে জানানোর জন্য কল করলাম কিন্তু ফোন অফ। এমন তো কখনও হয় না । আবার কোনো বিপদ হল কিনা??
* কি শুরু করলা তোমরা? এটা আবার মামা কে বলার কি হল?
# আরে এত বড় খবরটা দিতে হবে না ? আম্মু, আমি দেখছি। তুমি পিজ্জাটা কেটে দাও।
আমি এই সুযোগে মামা কে কল করে দেখলাম মামার মোবাইল বন্ধ। কোন উপায় না পেয়ে একটা ই-মেইল করে রাখলাম।
——————-
মামা,
দারুন খবর আছে। মিস করতে না চাইলে তাড়াতাড়ি ফোন কর।
ইমু।
———————
[1] মোবিস্ক্রিন(কাল্পনিক) –প্রোজেক্টরের মত, মোবাইল থেকে দেয়ালে ভিডিও দেখার যন্ত্র
[2] এয়ারপ্লাগ- তারবিহীন মোবাইল থেকে শব্দ শোনার যন্ত্র
[3] মাইবুক(কাল্পনিক)- নতুন প্রযুক্তির ল্যাপটপ৷
[4] ড্রোভার (কাল্পনিক)– ড্রোনে করে খাবার/ পণ্য বাড়িতে দিয়ে যায়৷
[5] ড্রোপ্যাড (কাল্পনিক) –বাড়ীর ছাদে যেখানে ড্রোন নামে।
[6] টিপটপ (কাল্পনিক)- মোবাইল থেকে টাকা আদান প্রদান করার সফটওয়্যার৷