দেখতে দেখতে এক সপ্তাহ শেষ হয়ে গেল। আম্মু শুধু পড়াশুনা করতে বলে, কিন্তু এর বাইরেও যে একটা জীবন আছে সেদিকে কারো কোনো খেয়াল নেই। সবাই ভুলে গেলেও আমি তা ভুলি না। সারাদিন আমাকে অনেক কাজ করতে হয়। ২৪ ঘন্টা কি পড়াশুনা করা যায় নাকি ?
সকালে স্কুল দিয়ে শুরু হয় আর শেষ হয় রাতে ডায়েরি লিখতে লিখতে। শুনেছি আগে নাকি মানুষ প্রচুর কাগজের ব্যবহার করত। এখন সব ডিজিটাল। তবে আমি বিজ্ঞান মেলার জন্য পুরাতন কাগজ থেকে নতুন কাগজ তৈরি করেছি। মামা অনেক সাহায্য করেছে। আমার কাছে মামা কে মাঝে মাঝে পাগল মনে হলেও মনে মনে আমি মামার মত হতে চাই।
মামার নাম রফিকুল ইসলাম, ডাক নাম রাহুল। আমরা সবাই রাহুল মামা বলে ডাকি। মামার বয়স ৪০ বছর হলেও, মামা কিন্তু একটুও গম্ভীর না। কাজকর্ম দেখলে অপরিচিত যে কেউ ভাববে মামা কলেজে পড়ে। চুলে একটু পাক ধরেছে, চশমাও পরে। কিন্তু সবসময় চশমা পরে না । যখন মামা অনেক পড়াশুনা করে, কোন বিষয়ে খুব সিরিয়াস থাকে তখন মনের অজান্তেই মামা চোখে চশমা পড়ে।
কাল মামা আসবে, কত কথা যে জমে আছে পেটের ভিতরে। মামা আবার খুব সকালে চলে আসবে, তাই তাড়াতাড়ি শুয়ে পরলাম, কিন্তু ঘুম আসলো না। মামা আসলে মামার নতুন মোবাইলের হলোগ্রাফিক মোডে[1] আমার প্রিয় রেড-স্টার মুভিটা দেখতে হবে। শুয়ে শুয়ে কাল কি কি কাজ করতে হবে তার একটা প্ল্যান করে ফেললাম। তারপর মামার মত সবগুলো মাইম্যাপে আপডেট করে রাখলাম। মামা আসলে এই প্ল্যান টা মামার সাথে শেয়ার করা যাবে। আগামীকালের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ কাজ হল, নিউ মার্কেট থেকে আপুর জামা নিয়ে আসা। এই সব চিন্তা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম, বুঝতেই পারলাম না।
সকালে ঘুম ভাঙতেই চোখ পড়লো ঘড়িতে। হায় হায় ৮ টা বাজে! সর্বনাশ, নিশ্চয়ই মামা চলে আসছে। এক দৌড়ে চলে গেলাম ড্রয়িং রুমে। যা ভেবেছি তাই, আম্মু আর মামা আমাকে নিয়ে গল্প করছে। আর আম্মু আমার নামে যা ইচ্ছা তাই বলে যাচ্ছে। আমি নাকি দোকানদার মামার মোবাইল ঠিক করে দিয়েছি। শুনে মামা বিকট শব্দে হাসছে। মামা মনে হয় বুঝতে পেরেছে, আম্মু একটু বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলছে। আর সময় দেয়া যাবে না, শেষে আমি রকেটও বানিয়ে ফেলতে পারি। আমি পিছন থেকে এক দৌড়ে মামার সামনে হাজির।
# মামা, তুমি এসেছ, কিন্তু আমাকে ডাকলে না কেন?
% এসেই তোকে ডাকতে চেয়েছিলাম, পরে ভাবলাম- একটু ঘুমা। এমনি আজ শনিবার।
# কি দরকার ছিল সকাল সকাল মনে করিয়ে দেয়ার? আজ কিন্তু অনেক কাজ।
% তো, কি এত কাজ শুনি। সামনে কি আবার কোন সায়েন্স প্রোজেক্ট আছে নাকি?
# আরে না মামা, কি যে বল না। আমি কি শুধু সায়েন্স প্রোজেক্টের জন্য তোমার সাহায্য নেই নাকি?
% তা না। এখন বল কি করতে হবে।
আমাদের কথা শুনে আম্মু একটু অবাক হয়েছে। আম্মু ভেবেছিল মামা জানে যে নিউ মার্কটে যেতে হবে। আর মামা তা জানার পরও চলে এসেছে। আম্মু মনে মনে খুশী হয়েছিল। যাইহোক, এখন দেখছে সব উল্টো। পরে আবার আম্মুকেই যেতে হয় নাকি আবার, তাই তাড়াতাড়ি মনে করিয়ে দিল আজ আমাদের নিউ মার্কেটে যেতে হবে।
~ কিরে ইমু, তুই মামা কে বলিস নাই যে আজ নিউ মার্কেটে যেতে হবে?
# না মানে বলেছি, তুমি একটা কাজ দিয়েছ কিন্তু কি কাজ সেটা বলি নাই।
আমাদের কথা শুনে মামার আর বুঝতে বাকি নাই যে, আমি ইচ্ছে করে মামাকে বিপদে ফেলেছি। কিন্তু কি ভাবতেই মামা রাজি হয়ে গেল। তা দেখে আমি আর আম্মু দুই জনেই অবাক।
% আরে এটা আগে বলবি না! আমি তো ঐ দিকেই যেতাম। নীলক্ষেতে একটু কাজ আছে। তো নিউ মার্কেটের কাজ টা কি ?
~ একটা জামা বদল করে আনতে হবে।
# সর্বনাশ! জামা বদলানো তো অনেক ঝামেলার কাজ। কোন দোকান, দোকানে কে ছিল, আবার যে জামা আনতে হবে সেটা আছে কিনা? কত কি! এতগুলো শর্ত পূরণ করে একটা কাজ করতে হবে ?
আমার দিকে তাকিয়ে, মামা আবার বলল-
% তার উপর আজ শনিবার।
বলেই মামা হেসে দিল। আমি সাথে সাথে মামাকে সান্তনা দিয়ে বললাম –
# আরে মামা, তুমি এত চিন্তা করছো কেন ? আমি আছি না !
মামা এবার অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো। আর ঐ দিকে আম্মু ডাকছে তাড়াতাড়ি নাস্তা করে বের হবার জন্য।
# মামা, তুমি আমার মোবাইলে দেখ। আমি রাতে সব ঠিক রেখেছি আর তোমার সাথে শেয়ার করে রেখেছি। আর মানিকের সাথেও কথা বলেছি। মানিকই তো আজ যেতে বলেছে।
% হুম, সবই বুঝলাম। তো এই মানিক টা আবার কে?
# মোফাজ্জল মামার ছেলে।
মামা একটু অবাক হয়ে –
% মোফাজ্জল নামে আমার তো কোন ভাই আছে বলে মনে হচ্ছে না।
মামার মুখ দেখেই বুঝতে পারলাম, আমি ঠিক ভাবে পরিচয়টা দিতে পারি নাই। মাঝে মাঝে আমার যে কি হয়!
# আরে মামা, আমরা যে দোকানে যাবো, তার মালিকের নাম হল মোফাজ্জল। তিনি আম্মুকে আপা ডাকে। তাই তিনি আমার মামা। আর তার ছেলের নাম হল মানিক । আমি তাদের ই-মেইল করেছিলাম। মানিক উত্তর দিয়েছে। আর গতকাল রাতেও মানিক আমাকে ই-মেইল করেছিল, আজ আমরা যাবো কিনা তা জানার জন্য। আমার সাথে দেখা হয়নি তার। কিন্তু মনে হয় খুব ভাল ছেলে। আবার বলল, কি যেন কথা আছে আমার সাথে!
এক নিশ্বাসে এত গুলো কথা বলার পর খেয়াল করলাম মামা কি যেনো করছে। আমার দিকে খুবই উচ্ছ্বাস নিয়ে তাকিয়ে বলল-
% সাবাস ! তুই তো সারাদিনের কাজ একাই করে রেখেছিস। আমরা শুধু যাব আর নিয়ে আসবো।
বলতে বলতে মামা ম্যাপটা হলোগ্রাফিক মোডে দিলেন। এভাবে ম্যাপ দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। মামা ম্যাপে তারসাথে কিছু কাজ যোগ করে সারাদিন কি কি করবে। এরপর আমাকে সব বুঝিয়ে দিলেন।
ছবিঃ হলগ্রাফিক ম্যাপ
% শোন, আমরা ২নং গেইট দিয়ে ঢুকে জামা নিয়ে আবার এই দিক দিয়ে বের হয়ে নীলক্ষেত যাব। আমার সেখানে ১০ মিনিটের মত সময় লাগবে। আর সব কাজ যদি ১১ টার মধ্যে শেষ করতে পারি তাহলে তোকে আজ আমি আমার হালিম খাওয়াব।
বলেই মামা হাসি দিলেন। আমিও বুঝতে পারলাম মামা আমার প্রিয় “মামা হালিম” খাওয়াবে। মনে মনে ভাবলাম অনেক দিন রিক্সায় উঠি না। ঢাকা শহরে এখন রিক্সা অনেক কম। মেট্রোরেল হবার পর এখন তেমন জ্যাম নেই। মামার কাছে গল্প শুনেছি আগে নাকি ঢাকায় অনেক ট্রাফিক জ্যাম থাকতো। যার প্রধান কারন ছিল রিক্সা আর যত্রতত্র পার্কিং। আর চারপাশে নাকি প্রচুর পোস্টারও ছিল। এখন এসব কিছুই নাই। এখন সহজে কেউ আর রিক্সায় উঠে না। অন্যদিকে সাইকেল এখন অনেক জনপ্রিয়। আমারও একটা সাইকেল আছে। মামারও একটা আছে কিন্তু সেটাকে সাইকেল বললে ভুল হবে। কিসব যন্ত্রপাতি লাগানো। দেখতে অদ্ভুত লাগে। আজ যেহেতু মামা তার সাইকেলটা নিয়ে আসে নাই তাই আজই সুযোগ রিক্সায় উঠার।
# মামা, একটা কথা।
% বল কি বলবি, তুই আজ যা চাস পাবি। অনেক সুন্দর করে সব করে রেখেছিস। একদম আমার মনের মত হয়েছিস।
# মামা, আজ রিক্সায় ঘুরতে চাই।
% ওকে মামা, তুই চাইলে তাই হবে। আমরা নীলক্ষেত থেকে রামপুরা রিক্সায় আসবো। তোকে বাসায় নামিয়ে আমি শান্তিনগর চলে যাব।
শুনেই কত যে ভালো লাগছে। অনেকদিন পর আজ রিক্সায় ঘুরব। রিক্সায় ঘোরার একটা অন্যরকম ব্যাপার হল, রিক্সা ফ্লাইওভার ব্যবহার করে না। তাই এক অন্যরকম ঢাকা শহর দেখা যায়। ঢাকা শহরকে তিনটি স্তরে ভাগ করা যায়। একটা শহর মাটির উপরে, একটা নিচে, আর একটা হল এই দুইটার মাঝে। মাঝের শহরটা হল সবচেয়ে পুরাতন শহর। মনে মনে ঠিক করে রাখলাম আজ অনেক ছবি তুলব আর মাইম্যাপে জমা দিব। এখন ব্যস্ততার জন্য অনেকেই এই মাঝের পুরাতন শহরটা দেখার সুযোগ পায় না।
[1] হলোগ্রাফিক মোড, ত্রিমাতৃক ছবি দেখার পদ্ধতি