আম্মুর পিছনে ঘুরতে ঘুরতে আমি ক্লান্ত। যা রোদ, তারমধ্যে আম্মু এসেছে নিউ মার্কেটে। সেই কখন থেকে আম্মুর পিছন পিছন ঘুরছি, কিন্তু আম্মু কিছুই কিনছে না। এই দোকান সেই দোকান ঘুরে বেড়াচ্ছে আর দরদাম করছে। পছন্দ হলে দোকানদার দাম বেশি চাচ্ছে, আবার অন্য দোকানে গিয়ে কিছুই পছন্দ হচ্ছে না । প্রায় একঘন্টা ঘুরে আম্মু মাত্র একটা থ্রি-পিছ পছন্দ করেছে। এখনো ইমি আপুর জন্য থ্রি-পিছ আর আমার জন্য টি-শার্ট কেনা বাকি। তবে যা অবস্থা, তা দেখে মনে হচ্ছে রাতের আগে আর বাসায় ফেরা হবে না।
একঘণ্টা ঘুরাঘুরির পর আম্মু বলছে, ২ নং গেটের পাশের ৩টা দোকানের পর যে আকাশী রঙের জামাটা দেখেছে সেটাই আম্মুর পছন্দ হয়েছে ।
~ এই ইমু, ২ নং গেইটটা কোন দিকে রে?
# জানি না, কাউকে জিজ্ঞাসা করতে হবে ।
~ ঐ আকাশী জামাটাই কিনব, কিন্তু কে যে কম দাম বলল? একজন ২২০, আর একজন ২৭০।
# আমার মনে হয়, এখন গিয়ে আর পাবে না। বিক্রি হয়ে গেছে।
~ কি বলছিস এসব? তাড়াতাড়ি খুঁজে বের কর।
সর্বনাশ, এখন আমি কি করি? কোথায় খুঁজে পাই সে দোকান? অনেক খুঁজে ২ নং গেইট বের করলাম।ঘেমে অবস্থা একদম খারাপ। আম্মুকেও অনেক ক্লান্ত লাগছিল। কিন্তু যেই আমরা ২ নং গেইটের কাছে পৌঁছেছি, আম্মুর মুখের ক্লান্ত ভাবটা যেন হঠাৎ নাই হয়ে গেল। দোকান খুঁজে বের করতে আম্মুর কয়েক সেকেন্ড লাগলো। দোকানে গিয়েই আকাশী জামাটা চোখে পড়ল। সবার উপরেই আছে। মনে হয় একটু আগে অন্য কেউ দেখে গেছে। আম্মু দোকানে ঢুকেই জামাটা হাতে নিয়ে কথা বলা শুরু করল।
~ এই, এটা কত?
দঃ খালা, ৩০০ টাকা ।
~ কি বল এইসব ? তোমার দোকানে কি ঘন্টায় ঘন্টায় দাম বাড়ে নাকি?
দঃ ও খালা আপনি? আগে ২৭০ বলছিলাম এখন ৩০০। এইটা লাস্ট পিছ। এক দাম ৩০০।
আম্মুর তো মাথায় বারি! তাহলে এইটা সেই দোকান না !!! অবস্থা দেখে আমারও মাথায় হাত। এখন কি হবে ? নিশ্চয়ই আম্মু আবার ঘুরাঘুরি শুরু করবে। এরপর আরও ২টা কেনা বাকি। আজ আমি শেষ! কেন যে রাজি হলাম আসার জন্য! মামাকে খুব মিস করছি। মামা থাকলে এতক্ষনে বাসায় থাকতাম। মামা কেমন করে যেন আম্মুকে ম্যানেজ করে ফেলে। কিন্তু এখন আর আফসোস করে কি হবে? এসে যখন পরেছি, জামা না কিনে আর বাসায় ফেরা হচ্ছে না। হঠাৎ আম্মুর ডাকে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। আম্মুর মন, মেজাজ খুব খারাপ।
~ কি করি বলতো?
# বাদ দাও। আজ আর হবে না। আগেই বলছিলাম শনিবার না আসতে। শনিবার একটা কুফা।
সাধারণত আমি শনিবারে তেমন গুরুত্বপুর্ন কাজ করি না। খুব ছোটবেলায় একবার কাক আমার উপর ইয়ে করে দিয়েছিল। সেই থেকে শুরু। সর্বশেষ গত শনিবার গেমজোন টি-১৫[1] এ ক্রিকেট খেলার সময় পরপর দুই ম্যাচে ইমি আপুর কাছে হেরেছি। আর আজকেও শনিবার। যদিও আমি কোন ধরনের কুসংস্কার বিশ্বাস করি না। মামা থাকতে আমার কোন ভয় নেই। কিন্তু এই শনি-টা আর গেল না। যদিও মামার কাছেও এর কোন ব্যাখ্যা নেই। মামা শুধু বলে, শনি- মঙ্গল সবই এক, বাকি সব মনের ব্যাপার। যাইহোক, এইসব বলে কোন লাভ হবে না আগেই জানতাম। তাই অন্য দোকানের কথা আম্মুকে মনে করিয়ে দিলাম।
# এখানে দাঁড়িয়ে থেকে তো লাভ নাই। চল বের হই।
আম্মু মন খারাপ করে বের হয়ে গেল। বের হওয়ার সাথে সাথেই আমি বললাম এই জামা তো আর একটা দোকানে ছিল। কথাটা শুনেই আম্মুর মুখে প্রাণ ফিরে এলো।
~ হ্যা, তাই তো ! কিন্তু কোন দোকানে ?
আমার তো আবার মাথায় হাত। মনে মনে নিজেকে বকতে লাগলাম। কেন যে “খাল কেটে জামা কিনতে আসলাম”। আরে কি আবোলতাবোল বকছি। নিজের অবস্থা দেখে নিজেরই হাসি পাচ্ছে। কিন্তু আল্লাহ্র কি রহমত, আমার আর আম্মুর দুইজনের একসাথেই মনে পড়ল এই দোকান থেকে বের হয়ে আমরা ডান দিকে হেঁটেছি এবং ঐ দোকানটি বেশি দূরে না ।
# আম্মু!
~ হুম !
# তুমি কি ঐ জামাটিই কিনবে ?
একটু মেজাজ খারাপ করে আম্মু বলল –
~ আর কিছু আছে কেনার মত?
আমার আর বুঝতে বাকি রইল না আজ শনিবার । হঠাৎ মামার কথা মনে পড়ল। এখন মামা থাকলে কি করত? নিশ্চয়ই আমার মত হা-হুতাশ করত না। মামার কথা ভাবতে ভাবতেই মামার গ্যাজেট[2] গুলোর কথা চোখের সামনে ভাসতে লাগলো। মামার মোবাইলে জিপিএস আছে আর তা দিয়ে মামা প্রতিদিন বের হবার আগে চিন্তা-ভাবনা করে বাসা থেকে বের হয়। ম্যাপের উপর নোট করা থাকে কোথায় কখন যাবে, কি কাজে যাবে সবকিছু। মনে হতেই নিজেকে গাধা গাধা মনে হতে লাগলো। কিছুই শিখলাম না মামার কাছ থেকে। আগে মনে পরলে আর এত কষ্ট করতে হত না কারন আমার মোবাইলেও জিপিএস আছে এবং এটা কিভাবে ব্যবহার করতে হয় তা মামা গত সিলেট ঘুরতে যাবার আগে শিখেয়েছিল। আম্মুর পিছনে হাঁটতে হাঁটতে আমি পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে ম্যাপে নিউ মার্কেট খুঁজে বের করলাম। কিন্তু যা ভেবেছিলাম তাই! ম্যাপে শুধু বড় দোকানের নামগুলো আছে।
আম্মু হঠাৎ এক দোকানের সামনে দাঁড়াল আম্মুকে দেখেই দোকানদার বলা শুরু করল-
দঃ আপা, আপনারে আগেই বলছিলাম ২২০ টাকার নিচে এই জামা আপনি ঢাকা শহরে কোথাও পাবেন না। কিন্তু আপনি বললেন, এ রকম জামা নাকি ১৫০ টাকায় পাওয়া যায়। আপা, আমিও ১৫০ টাকায় দিতে পারব। কিন্তু সেটা আপনি একবারের বেশী দুইবার পরতে পারবেন না।
কথা বলার শুরুতে মুচকি হাসি থাকলেও কথা শেষ হল সবগুলো দাঁত বের করা হাসি দিয়ে। দোকানদার বুঝে গেছে এই জামা আম্মু নিবেই। আম্মু মনে হয় একটু লজ্জা পেল। দোকানদারের বয়স রাহুল মামার মত। আমি আলোচনার বিষয় অন্য দিকে নেওয়ার জন্য চেষ্টা করলাম।
# মামা, এত বড় দোকান, কিন্তু ম্যাপে নাই কেন ? খুঁজে বের করতে যা কষ্ট হল।
এইবার দোকানদার মামা মনে হয় একটু লজ্জা পেল। এই যুগে মাইম্যাপে[3] সবকিছুই আছে। আর প্রায় সবাই এখন মাইম্যাপ ব্যবহার করে। এখন সবার দুইটা পরিচয়। একটা হল বাস্তব জগত, আর একটি হল কল্প জগত। এখন সবারই ই-মেইল, ওয়েব সাইট আছে। আর মাইম্যাপ হচ্ছে বাস্তব জগতের প্রতিচ্ছবি। এখানে না থাকার অর্থ হচ্ছে আপনি থেকেও কোথাও নেই!
দঃ আরে মামা, আমি কি এইসব বুঝি? ম্যাপে আবার দোকানের নাম দেয় কিভাবে? এই যে দোকানের কার্ড নিয়ে যাও। আমার ছেলে ওয়েব সাইট খুলছে। দোকানের সব জামা এখন এই ওয়েব সাইটেও দেখা যায়।
কথা শুনে আমি মনে মনে একটু খুশি হলাম আর যাইহোক, ম্যাপ কি জিনিস তা আর বুঝাতে হবে না। এর আগে একদিন আমি আর মামা রিক্সা দিয়ে যাচ্ছিলাম। শাহবাগ থেকে নীলক্ষেত । মামা যতই ম্যাপ দেখে ভিতর দিয়ে যেতে বলুক না কেন, রিক্সাওয়ালা যাবেই না। ম্যাপে নাকি কালাজ্বীন থাকে। এর আগে কোন এক বৃষ্টির দিনে ম্যাপ দেখে চলতে গিয়ে নাকি বিশাল গর্তে পড়েছিল । আর একদিন এক যাত্রী জগন্নাথ হল যাবে। রিক্সাওয়ালা মামা চিনতো না, তাই যেতে চায় নাই। শেষে যাত্রীর অনেক অনুরোধের পর যেতে রাজি হয়। প্রায় ১ ঘন্টা ঘুরাঘুরির পর পুরান ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে নামে। এরপর ঐ যাত্রী নাকি ভাড়া না দিয়ে চলে গেছে। এমন আরো অনেক কিছু বলল। এই জ্বীনে ধরলে নাকি সারাদিন ঘুরলেও নীলক্ষেত খুঁজে পাওয়া যাবে না । আরও কত কি !
[1] গেমজোন টি-১৫ (কাল্পনিক), ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ভিত্তিক খেলা
[2] গ্যাজেট (কাল্পনিক), প্রয়োজনীয় কাজ করার জন্য ছোট কোন যন্ত্র বা সফটওয়্যার
[3] মাইম্যাপ(কাল্পনিক), মানচিত্র, যেখানে প্রতিদিনের কাজ তালিকা করে রাখা যায়।